গুমোট আর্তনাদ। হৃদয়ে জ্বলছে আগুন। সেই আগুনে প্রতিদিন পুড়ছি আমি। কী হতে চেয়েছিলাম। আর কি হয়ে গেলাম। সবই যেন চোখের ঝিলিক। জানেন, ছোট্ট বেলায় নাচে মুগ্ধ করতাম পাড়া প্রতিবেশী, স্কুল ও সহপাঠীদের। সবাই আমার নাচ থেকে হাত তালি দিতেন। প্রশংসা করতো। তাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় আমি নৃত্যশিল্পী হওয়ার শপথ নেই। কিন্তু সেই শপথ আমার অঙ্কুরেই ভেঙে যায়।
এখন আসল নাম হারিয়ে ধারণ করেছি ছলনার। তাই নাম এখন ছলনা। সবাই ডাকে ছলনা হিজড়া বলে। আর বাবা-মার দেয়া নাম ছিল আকবর। বাবা নুর ইসলাম বগুড়ার কসাই পাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। আকবরও এই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। মা সংসারের কাজ করতেন। চার ভাই ও ১ বোনের মধ্য তিনি তৃতীয়। একমাত্র বোনের বিয়ে হয়েছে। স্বামী ডাক্তার।
ছলনা হিজড়া বলেন, ছোটবেলার দিনগুলো অনেক সুখকর ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা খেয়ে পড়ার টেবিলে বসতাম। বাবা নিজে আমাদের ভাই বোনদের একসঙ্গে পড়াতেন। পড়া শেষ হলে গোসল করে ভাত খেয়ে স্কুলে যেতাম। স্কুল ছুটির পর বাসায় এসে বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করতাম। তবে ছোটবেলা থেকে আমার মাঝে একটু মেয়েলি স্বভাব ছিল। আমি মায়ের শাড়ি, চুড়ি পড়তাম। লিপস্টিক আলতা পরে খেলা করতাম। বাবা মা আমাকে অনেক আদর করতো। কিন্তু মেয়েলি স্বভাবের কারণে অনেক সময় বকা দিত। মাঝে মাঝে মারধর দিত। কোন লাভ হয়নি। আমার মতো চলতে থাকি। বড় হয়েও আমি সেই কাজগুলো করতাম।
তিনি বলেন, এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার পর তিন মাস কোন পড়ালেখা ছিল না। সেই সময়টা আমাদের স্কুলে একটা নাটক আর নৃত্যর অনুষ্ঠান হয়। নাম ছিল অপরূপা। আমিও তাতে অংশ নেই। সে অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন ঢাকা শিল্পকলা একাডেমির মো. ইবরাহিম খাঁন নামের এক স্যার। বাড়ি আমাদের বগুড়ায়। তিনি আমার অভিনয় নাচ দেখে পছন্দ করেন। আশ্বাস দেন আমি ঢাকায় গেলে অনেক ভালো কিছু করতে পারবো। আমার বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলে তিনি রাজি করান। এরপর স্যারের সঙ্গেই আমি ঢাকা চলে আসি। ভালোভাবে নাচ ও অভিনয় শিখার জন্য ভর্তি হই শিল্পকলা একাডেমিতে। ছোট ছোট বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে থাকি।
তিনি বলতে থাকেন, সেখানেই একটা অনুষ্ঠানে পরিচয় হয় হায়দার হিজড়ার সঙ্গে। তিনি আমার মেয়েলি আচার আচরণ দেখে আমাকে হিজড়ার দলে আসার কথা বলেন। কিন্তু আমার এসব পছন্দ হয়নি। অনেক ভয় লাগতো আমার। আর আমার স্বপ্ন ছিল আমি একজন ভালো নৃত্যশিল্পী হবো। কিন্তু তিনি আমার পিছু ছাড়েননি। দলে নিয়ে গিয়ে আমাকে বোঝাতেন। হিজড়া হলে অনেক টাকা আয় করা যাবে। অনেক আনন্দ ফুর্তি করা যাবে। বড় বড় পার্টিতে অংশ নেয়া যাবে। এসব বলে আমাকে রাজি করানোর চেষ্টা করেন। তারা আমাকে বাসার যাওয়ার জন্য ঠিকানা দিয়ে দেন। তাদের কাজ দেখার জন্য আমাকে কাওরান বাজার আসার কথা বলতেন।
ছলনা হিজরা বলেন, একদিন সত্যি সত্যি তারা কী কাজ করে দেখতে চলে যাই কাওরান বাজার। দেখি তারা বিভিন্ন দোকান থেকে টাকা তোলেন। এভাবে কয়েকদিন তাদের কাজ দেখি। এক সময় হায়দার হিজড়া আমাকে অনেকটা জোর করেই তার দলে নিয়ে নেন। তারপর অপারেশন করে আমাকে বানানো হয় হিজড়া। আমার নতুন নাম দেয়া হয় ছলনা। তারপর থেকেই তাদের চলা ফেরা আচার আচরণের সঙ্গে মিশে যাই। দলের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় টাকা তুলতে যেতাম। বাসায় আমার মতো আরো ৩০-৪০ জন হিজড়া ছিল। সবাই একসঙ্গে নাচ গান আনন্দ ফুর্তি করতাম। আস্তে আস্তে ভালো লাগতে শুরু করে। কিন্তু মনের মাঝে আমার বাড়ির প্রতি অনেক টান ছিল। প্রথম প্রথম আমি বাড়িতে যোগাযোগ করতাম। যেদিন আমি বাড়িতে বলি আমি হিজড়ার দলে যোগ দিয়েছি সেদিন বাবা মা আমার জন্য অনেক কান্না করেছিল। আমাকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছিল। বাড়ি চলে যাওয়ার জন্য।
তিনি বলেন, আমি আমাদের সর্দারকে অনেক বলেছি যে, আমি এই লাইনে থাকবো না। কিন্তু তিনি আমাকে যেতে দেননি। তখন হয়তো আর সুযোগও ছিল না। বরং আমার হাসি খুশির জন্য ভালো খাওয়া দাওয়া নাচ গানের আয়োজন করতেন। এভাবেই চলে যায় আরো কিছুদিন। তারপরও আমি চুরি করে অনেক জায়গায় চাকরির জন্য যেতাম। একটা চাকরি পেলে হয়তো লাইনটা ছেড়ে দিতে পারতাম। কিন্তু কেউ আমাকে চাকরি দেয়নি। সবাই বলে আমি নাকি হিজড়া। আমাকে চাকরি দিলে সমাজ নানান কথা বলবে। আমরা খারাপ কাজ করি। চাঁদাবাজি করি। সমাজের মানুষ আমাদের জন্য নষ্ট হয়ে যাবে। ব্যবসাও করতে পারিনি। তাই একটা সময় আর এসবের চিন্তা ছেড়ে দিয়ে দলের সঙ্গেই নিয়মিত কাজ শুরু করি। আমি আমার জগৎটাকে তাদের মতো সাজানোর চেষ্টা করি।
নতুন ঠিকানা নিয়ে তিনি বলেন, এখন আমি থাকি মগবাজার কাঁচাবাজারের গলি। সেখানেই আমরা সবাই একসঙ্গে থাকি। কিছুদিন আগে আমাদের সর্দার মারা গেছেন। এখন আমাদের কোনো সর্দার নেই। তাই এখন আমাদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। প্রতিদিন আমাদের দল কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে বিভিন্ন এলাকার বাসা বাড়ি অফিস গাড়ি দোকান থেকে চাঁদা তোলে। এক একটি দল গড়ে প্রতিদিন পনের বিশ হাজার টাকা উঠায়। সেই টাকা দিয়েই আমরা আমাদের যাবতীয় খরচ চালাই। তার পাশাপাশি আমি সেলাইয়ের কাজ করি। সেখান থেকে আমি আরো কিছু টাকা আয় করতে পারি।
ছলনা হিজড়া বলেন, এখন আর বাড়িতে এত বেশি যোগাযোগ হয় না আমার। মাঝে মধ্যে মোবাইল ফোনে কথা বলি। কারণ আমাদের জগৎটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। এ জগতের সঙ্গে কারো মিলবে না। আমাদের মানুষ অনেক ভুল বোঝে। খারাপ দৃষ্টিতে দেখে। আমরা যখন চাঁদাবাজি করি। অনেকেই টাকা দিতে চায় না। কিন্তু আমরা টাকা না তুললে খেয়ে-পরে বাঁচবো কিভাবে। সরকার তো আমাদের জন্য কোনো কাজের ব্যবস্থা করে না। কাজের ব্যবস্থা করলে কেউ না ছাড়লেও আমি টাকা তোলা বন্ধ করে দিতাম। দুঃখের সঙ্গে ছলনা বলেন, সবার কাছে অনুরোধ- কেউ ইচ্ছে করে হিজড়া হবেন না। এটা একটা অভিশপ্ত জীবন।
No comments:
Post a Comment