অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত: অর্থনৈতিক কাঠামো ও সামজিক উন্নয়ন স্তরের উপর ভিত্তি করে বিশ্বের
সকল সমাজ ও রাষ্ট্রে শিশুদের কিছু কিছু উৎপাদনমূলক কর্মে যুক্ত থাকাটা যদিও সাধারণ
হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তারপরও শিশুশ্রম সমগ্র বিশ্বে আজ বিশেষ উদ্বেগের কারণ হয়ে
দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও পারিবারিক প্রয়োজনে বাংলাদেশে
ব্যাপকভাবে শিশুশ্রম দেখা যায় এবং বিষয়টিকে খুব সাধারণ বলে মনে করা হয়।
অনেক পরিবারের বেঁচে থাকার
জন্য তাদের সন্তানের আয়ের উপর নির্ভর
করে, তাই শিশুশ্রম প্রায়শ অত্যন্ত মূল্যবান হয়ে
পড়ে। উপরন্তু, নিয়োগকর্তারা প্রায়শ
সস্তা এবং প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে
বেশি অনুবর্তী ও আজ্ঞাবহ হিসেবে
বিবেচনা করে শিশুদের কর্মে নিযুক্ত
করতে পছন্দ করেন। বস্তুত, উচ্চহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মত বিষয়ের কারণে বাংলাদেশের
মত দরিদ্র উন্নয়নশীল দেশে শিশুশ্রমের হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
দেশের শ্রম শক্তির
একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অনানুষ্ঠানিক
শ্রম খাতে জড়িত এবং
দেশের ক্রমবর্ধমান অনানুষ্ঠানিক
শ্রম খাতের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল
শিশুশ্রম। দেশে প্রচলিত আইনের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমখাতে
শিশুদের নিযুক্ত করার
খুব সামান্য সুযোগ আছে। কিন্তু বাস্তবে অনেক
সংখ্যক শিশুকে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করতে দেখতে পাওয়া যায়।
ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও)
কর্তৃক ২০০৬ সালে পরিচালিত বেইজ লাইন সার্ভে অন চাইল্ড ডোমেস্টিক লেবার ইন
বাংলাদেশ এ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সের ৭.৪ মিলিয়ন শিশু বিভিন্ন
কর্মে নিয়োজিত রয়েছে
যাদের মধ্যে ৪.৭ মিলয়ন শিশুর বয়স ৫ থেকে ১৪ বছর। শিশুশ্রমে নিয়োজিত ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সের ৩.২
মিলিয়ন শিশুর মধ্যে ১.৩
মিলয়ন শিশু ঝুকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত রয়েছে।
তাছাড়া,
মোট শিশুশ্রমিকের মধ্যে ৪৯.৫ শতাংশ শিশু অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে
নিয়োয়িত রয়েছে। যাদের মধ্যে ২৮.৬
শতাংশ শিশু শ্রমিক দিনমজুর হিসেবে এবং ২৫.৪ শতাংশ শিশু পরিবহণ খাতে নিযুক্ত রয়েছে।
২০০৬ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফের পরিচালিত যৌথ সমীক্ষায় দেখা যায়
যে জাতীয়ভাবে ১২.৮ শতাংশ, বস্তি এলাকায় ১৯.১ শতাংশ এবং ১৭.৬ শতাংশ আদিবাসী শিশু শিশুশ্রমে নিয়োজিত রয়েছে।
২০০৪ সালে ইংরেজী জাতীয় দৈনিক নিউ নেশন এ
প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী বিশ্বের মোট শিশু শ্রমিকের ৫ শতাংশের উপর শিশু শ্রমিক শিল্প,
কারখানা, ওয়েল্ডিং কর্মশালা, চামড়া শিল্প, কৃষি খাত, পরিবহন খাত, নির্মাণ খাত, বিড়ি কারখানা, জাহাজ
ভাঙ্গা শিল্প, রেস্টুরেন্ট, চা স্টল,
গৃহশ্রমিক, পশু পালক, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, ব্যাটারি
তৈরি ও চার্জিং দোকান, বিছানাপত্র উৎপাদন দোকান, কর্মকার, ইট ভাটা, বিল্ডিং
নির্মাণ, ডাইং কর্মশালা, ইলেকট্রিক দোকান, ওয়েল্ডিং, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, স্বর্নকার, লন্ড্রি
বয়, কুলি, মুদ্রণযন্ত্র কারখানা, রিক্সা- ভ্যান চালনাসহ বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত রয়েছে।
শিশুশ্রমে
নিয়োজিত শিশুরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান, বিনোদন,
অবসর, খেলাধুলার সুযোগসহ তাদের মানসিক বিকাশ ও সুষ্ঠুভাবে বেঁড়ে ওঠার জন্য
প্রয়োজনীয় অধিকাংশ অধিকার ও সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। তাছাড়া, তারা
সর্বদা পাচার, জীবনহানী, অপব্যবহার, ধর্ষন, যৌন হয়রানী ও শোষনের মত সহিংসতার
ঝুঁকির মুখে থাকে।
শিশুশ্রম
নিরসনের বিষয়টি আমাদের সংবিধানে স্পষ্টভাবে স্থান পাওয়া স্বত্বেও শিশুশ্রম নিরসন বা হ্রাসে সরকারের তেমন কোন কার্যকর
উদ্যোগ দেখা যায় না। স্বাধীনতা পরবর্তী শুরুতেই রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে শিশু
সুরক্ষার বিষয়টি ঘোষনা করেছে। সংবিধানের ১৪ ও ১৫ নং অনুচ্ছেদ শিশুর অধিকার ও
সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।
তাছাড়া,
১৭ নং অণুচ্ছেদ সরকারকে শিশুদের জন্য বিনা বেতনে ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা
নিশ্চিত করতে বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে এবং অণুচ্ছেদ ১৮ শিশুদের স্বার্থে বিশেষ
বিধান প্রয়োগের বিষয়টি ঘোষণা করেছে।
বাংলাদেশ
সরকার শিশু শ্রমের বিষয়টি অনুধাবন করে শিশু
অধিকার ও শিশুশ্রম সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন
করেছে। ২০১৩ সালে প্রণীত শিশু আইন অনুযায়ী- অন্য আইনে যা বলা থাকুক না কেন
শিশুর বয়স ১৮ বছর ধার্য করা হয়েছে।
উক্ত আইনের ৭০, ৭৮, ৭৯ নং ধারা অনুযায়ী শিশুকে ব্যক্তিগত পরিচর্যার
কাজে ব্যবহার করার ফলে যদি তার শারিরিক বা মানসিক ক্ষতি বা বিকৃতি ঘটে অথবা কোন
শিশুকে অসৎ
পথে পরিচালিত করা কিংবা
যৌনবৃত্তিতে প্রবৃত্ত করা বা তজ্জন্য
উৎসাহ প্রদান করা অথবা
কোন ব্যক্তির সাথে যৌন সঙ্গম
করানো বা তজ্জন্য উৎসাহ
প্রদান করা অথবা কোন শিশুর
দ্বারা আগ্নেয়াস্ত্র বা অবৈধ
ও নিষিদ্ধ বস্তু বহন বা পরিবহন
করানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন
নীতিমালা ২০১০’র মাধ্যমে সরকার আগামী ২০১৫ সালের মধ্যে সকল প্রকার শিশুশ্রম নিরসনে
একটি ফ্রেমওয়ার্ক ঘোষণা করেছে। শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে নিয়োগের জন্য
ন্যুনতম বয়স ১৪ বছর এবং ঝুকিপূর্ণ কাজের ক্ষত্রে ন্যুনতম বয়স ১৮ বছর নির্ধারণ করা
হয়েছে। তবে, শিক্ষা গ্রহণকে ব্যহত না করে ১২ থেকে ১৪ বচরের শিশুদের হালকা কাজের
অনুমতি এ আইনের মাধ্যমে প্রদান করা হয়েছে।
দোকান ও প্রতিষ্ঠান আইন
১৯৬৫ অনুযায়ী শারীরিকভাবে সুস্থ মর্মে কোন রেজিস্ট্রার্ড ডাক্তেরের সনদ ব্যতীত ১৭
বছরের নিচে কোন কিশোরকে দোকান বা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দানে অনুৎসাহিত করা হয়েছে।
চা বাগান অধ্যাদেশ ১৯৬২
অনুযায়ী- শিশু ও কিশোরের বয়স যথাক্রমে ১৫ ও ১৭ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। শারীরিকভাবে সুস্থ মর্মে কোন রেজিস্ট্রার্ড ডাক্তেরের সনদ
ব্যতীত কোন শিশু বা কিশোরকে চা বাগানে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সড়ক পরিবহণ শ্রমিক
অধ্যাদেশ ১৯৬১ অনুযায়ী- ১৮ বছরের নিচে কোন শিশুকে সড়ক পরিবহণ খাতে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ
সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ এবং গৃহশ্রমিক নিবন্ধন অদ্যাদেশ ১৯৬১ অনুযায়ী-যথাযথ
কর্তৃপক্ষের (স্থানীয় থানার পুলিশ) নিকট নিবন্ধন ব্যতীত গৃহশ্রমিক হিসেবে নিয়োগ
নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
খনি আইন ১৯২৩ অনুযায়ী ১৫
বছরের কম বসী কোন শিশুকে খনি শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ নিষিদ্ধ এবং শারীরিকভাবে সুস্থ
মর্মে কোন রেজিস্ট্রার্ড ডাক্তেরের সনদ ব্যতীত ১৭ বছরের কম বয়সী কোন কিশোরকে খনি
শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সংবিধান সকল
প্রকার জবর দস্তিমূলক শ্রমকে নিশিদ্ধ করে আইনী প্রতিকার পাওয়ার পথ প্রসস্থ করলেও শিশু শ্রমকে সরাসরি
নিষিদ্ধ
করেনি। এমনকি শিশু শ্রম সংক্রান্ত দেশে
প্রচলিত যেসব আইন ও নীতিমালাতেও শিশু শ্রম নিষিদ্ধ করেনি বরং শিশুদের কর্মক্ষেত্রে
নিয়োজিত করার ক্ষেত্রে কিছু মান্দণ্ড মেনে চলার বিষয় উল্লেখ করেছে। সর্বোপরি, এসকল আইন ও নীতিমালা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত
শিশু শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়গুলো অন্তর্ভূক্ত করেনি।
তাই কর্মক্ষেত্রে শিশুদের নিয়োজিত
করার ক্ষেত্রে শুধু মান্দণ্ড নির্ধারণ করলেই চলবে না। প্রয়োজন শিশুশ্রম
থেকে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্রীকৃতি প্রদান করে প্রাতিষ্ঠানিক
ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শিশুশ্রমকে সম্পূর্নভাবে নিষিদ্ধ করে আইন প্রনয়ন এবং প্রনীত
আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন। তবেই শিশুরা পূর্ণরুপে বিকশিত হয়ে দেশ ও জাতির সম্পদ
হিসেবে গড়ে উঠবে।
লেখক: তরুন ও উদীয়মান
মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী; জাস্টিসমেকার্স ফেলো, সুইজারল্যান্ড; একটি
শিশুকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত; ইমেইল: saikotbihr@gmail.com http://shahanur.blogspot.com/
======================================================================
"Advocate Shahanur Islam, an young, ascendant, dedicated & promising human rights activist/defender, lawyer & blogger in Bangladesh working for ensuring human rights, rule of law, good governance, peace & social justice for ethnic, religious, social and sexual minority community people including women and children". A Personal blog of Advocate Shahanur Islam. কপিরাইট © অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত. সকল সত্ব ® সংরক্ষিত. শাহানূর ডট ব্লগস্পট ডট কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোন নিবন্ধ, মতামত, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, ভিডিও চিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ব্যতীত ব্যবহার আইনগত দণ্ডনীয়. মোবাইল: ০১৭২০৩০৮০৮০, ইমেইলঃ saikotbihr@gmail.com, ব্লগ:www.shahanur.blogspot.com.
No comments:
Post a Comment