Saturday, June 7, 2014

কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা: প্রতিরোধে প্রয়োজন সমন্বিত প্রচেষ্টা!

অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত: বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিকতা ও নাগরিক সমাজের অক্লান্ত প্রচেষ্ঠায় মাধ্যমিক পর্যায়ের বিদ্যালয়ে ছেলেদের সাথে সাথে কন্যাশিশুদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য ভাবে লক্ষনীয়। এতে করে কন্যা শিশুদের বাড়ীর চার দেয়ালের গন্ডি ছেড়ে সর্বসাধারণের মাঝে বিচরণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কন্যাশিশুদের সর্ব সাধারণের মাঝে বিচরণের সুযোগে তাদের প্রতি যৌন হয়রানির ঘটনাও আশংকাজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

নারী অধিকারসহ রাষ্ট্রের নাগরিকদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার সিডও সনদসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক আইন ও চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। যদিও আল কোরান ভিত্তিক ইসলামী শরিয়া আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হবে বলে বাংলাদেশ সরকার সিডও সনদের দুটি গুরুত্বপূর্ন ধারা অনুমোদন না করে সংরক্ষিত রেখেছে।

সমাজে প্রচলিত চিরায়ত ধ্যান ধারণা ও ধর্মীয় সংস্কার (যা নারী ও শিশুর মর্যাদা ভুলন্ঠিত করে)র সরাসরি ফলাফল স্বরূপ আমাদের দেশে  সাধারণত নারী ও কন্যাশিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা সংঘটিত হয়ে থাকে। যদিও পুরষরা প্রধাণত নারীর প্রতি শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতন করে থাকে। তারপরও কিছু কিছু নারী সমাজে তাদের মূল্যহীন বলে মনে করে, প্রকারান্তে যা তাদের প্রতি নির্যাতন ও বৈষম্য বৃদ্ধি করে।

বাংলাদেশি সমাজ ব্যবস্থার প্রতিটি রন্ধে রন্ধে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য (যা লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা সৃষ্টি করে) প্রোথিত হয়ে রয়েছে। সকল সামাজিক প্রতিষ্ঠানে নারী পুরুষের মাঝে বৈষম্যমূলক ক্ষমতার সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে, এমন কি মাঝে মাঝে তা বৃদ্ধিতে ইন্ধন দেয়। অন্যভাবে বলতে গেলে নারীর প্রতি সহিংসতা আমাদের সমাজে দীর্ঘদিনের প্রথাগত ও সাংস্কৃতিভাবে গ্রহনীয় ও সহনীয় দেখা যায়

গত চার দশকে বাংলদেশ সরকার নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে অনেকগুলো আইন প্রণয়ন করেছে এবং মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট থেকে আমরা অনেকগুলো নির্দেশনা পেয়েছি। বাংলাদেশ সংবিধানে বর্নিত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমতার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ যৌতুক দমন আইন-১৯৮০, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০, এসিড সন্ত্রাস দমন আইন ২০০২ পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ পাশ করেছে। তাছাড়া, সরকার নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ প্রনয়ন করেছে।

২০০৯ সালে হাইকোর্ট বিভাগ  শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানীকে অপরাধ হিসেবে গন্য করে আইন প্রণয়নে সরকারকে নির্দেশনা প্রদান করেছে।  তবে যতদিন না আইন প্রণীত হয় ততদিন পর্যন্ত হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক ব্যবস্থা গৃহিত হবে। এখানে বিষেষভাবে উল্লেখ্য যে হাইকোর্টের নির্দেশনায় ইভটিজিংকে যৌন হয়রানির অন্তর্ভূক্ত করে যৌন হয়রানীর স্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে।

বাংলাদেশে নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা, বিশেষত যৌন হয়রানীর ঘটনা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। যদিও অধিকাংশ সহিংসতার ঘটনা লোক চক্ষুর আড়ালেই থেকে যায়। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় ৯১ শতাংশ বাংলাদেশী নারী ও কন্যাশিশু তাদের জীবনে কোন না কোন সময় যৌন হয়রানীর শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সী  ৮৭ শতাংশ কন্যাশিশু যৌন হয়রানীর শিকার।

নারী ও কন্যাশিশুরা তাদের প্রতি সংঘটিত সহিংসতা বা যৌন হয়রানীর বিষয়ে অভিযোগ করতে চাইলে অনেক প্রকার বাঁধার সম্মুখীন হয়ে থাকে। বিদ্যালয়ে যাওয়া আসার সময় কোন কন্যাশিশু যদি যৌন হয়রানীর শিকার হয় তবে সে তা তার বাবা মাকে বলতে ভয় পায়। কারণ যৌন হয়রানীর শিকার শিশুটি তাকে যৌন হয়রানি করতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রলুব্ধ করেছে বলে হয়রানীর শিকার কন্যাশিশুর বাবা মা মনে করতে পারে। তাছাড়া তার পরিবারে তা বলতে লজ্জা পায়।

সিডও সনদ ও হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী কোন কন্যাশিশুকে যৌন হয়রানী করা গুরুত্বর অপরাধ। একজন অবিবাহিত কন্যাশিশুর সাথে অনাত্বীয় কোন ছেলের যে কোন প্রকার সংসর্গ সাধারণভাবে বাংলাদেশী সমাজে প্রচলিত মুসলিম রীতি অনুযায়ী কঠিনভাবে নিষিদ্ধ। কন্যাশিশুর অমার্জিত চলাফেরার কারণে সে হয়রানীর শিকার হয় এবং তা উক্ত কন্যাশিশুর দোষ বলে সমাজ এখনো বহুলাংশে মনে করে। ফলে যৌন হয়রানীর শিকার কন্যাশিশুর বাবা মা তার নিরাপত্তার অজুহাতে তার বিদ্যালয়ে গমন বন্ধ করে দেয় এবং বিষয়টি কাউকে না জানিয়ে পরিবারের সম্মানের কথা বিবেচনা করে তার মতামত না নিয়েই তাকে জোড়পুর্বক বিয়ে দেয়।

অনেক সময় যৌন হয়রানীর শিকার কন্যাশিশুর অভিবাবক সহযোগিতা পাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট থানায় গেলেও পুলিশের অসহযোগিতা ও ঘুষ দাবীর সম্মুখীন হন। যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয় তবে হয়রানীর শিকার কন্যাশিশু ও তার অভিবাবক থানা থেকে আরো বেশী পরিমানে অসহযোগিতা ও সহিংসতার শিকার হন। এমন কি যৌন হয়রানীর ঘটনায় আদালত থেকেও সমানুভূতিশীল আচরণ পাওয়া যায় না। পুলিশ, বিচারক, আইনজীবীরা অনেক সময় যৌন হয়রানী বিরোধী হাইকোর্টের নির্দেশনা সম্পর্কে খুব ভালভাবে অবগত না থাকায় সমানুভূতিশীল আচরণ করেন না। ফলে যৌন হয়রানীর শিকার কন্যাশিশু নিজেকে ক্ষমতাহীন ও সমাজে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করেন এবং ফলশ্রুতিতে অনেক সময় আত্বহত্যা করে থাকে।

নারী ও কন্যাশিশুদের যৌন হয়রানীর হাত থেকে রক্ষা করতে শুধু আইন প্রণয়ন যতেষ্ঠ নয়। প্রয়োজন আইনের যথাযথ প্রয়োগ। শুধু আইন প্রনয়ন ও তার যথাযথ প্রয়োগেও সমস্যার সমাধান হবে না। পাশাপাশি সকল অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। কন্যা শিশুদের ঘরের বাহির হতে বাঁধা না দিয়ে পুত্র সন্তানকে অপরের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয় তা শিখাতে হবে। একই সাথে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান যেমন পুলিশ, বিচারক ও আইনজীবীদের যৌন হয়রানীর শিকার নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহানুভুতিশীল নয়, সমানুভুতিশীল আচরণ ও জেন্ডার সংবেদনশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। সর্বপরি, পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের মত সামজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সকল পুরুষ, নারী, কন্যা ও পুত্রশিশুদের জেন্ডার সংবেদনশীল হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তবেই যৌন হয়রানীসহ নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সকল প্রকার সহিংসতা ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্টা করা সম্ভব।

লেখক: তরুন ও উদীয়মান মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী; জাস্টিস্মেকার্স ফেলো, সুইজ্যারলান্ড; একটি শিশুকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত; ইমেইল: saikotbihr@gmail.com,  blog: www.shahanur.blogspot.com
 

====================================================================== "Advocate Shahanur Islam, an young, ascendant, dedicated & promising human rights activist/defender, lawyer & blogger in Bangladesh working for ensuring human rights, rule of law, good governance, peace & social justice for ethnic, religious, social and sexual minority community people including women and children". A Personal blog of Advocate Shahanur Islam. কপিরাইট © অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত. সকল সত্ব ® সংরক্ষিত. শাহানূর ডট ব্লগস্পট ডট কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোন নিবন্ধ, মতামত, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, ভিডিও চিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ব্যতীত ব্যবহার আইনগত দণ্ডনীয়. মোবাইল: ০১৭২০৩০৮০৮০, ইমেইলঃ saikotbihr@gmail.com, ব্লগ:www.shahanur.blogspot.com.

No comments:

Post a Comment