বাংলাদেশের আইনজীবী সমাজ আজ এক অভূতপূর্ব সঙ্কটের মুখোমুখি। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশে আইনজীবী সম্প্রদায়কে সরাসরি টার্গেট করে একটি সুপরিকল্পিত ও পদ্ধতিগত দমনাভিযান শুরু করেছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক ও অশনিসঙ্কেত বহন করছে।
ফ্রান্সভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা জাস্টিসমেকার্স বাংলাদেশ ইন ফ্রান্স (জেএমবিএফ), যারা নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের আইনজীবীদের ওপর সংঘটিত সহিংসতা পর্যবেক্ষণ ও নথিবদ্ধ করে, তাদের সংরক্ষিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্টে বিগত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ইউনুস প্রশাসন একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযান শুরু করে। এই অভিযানে আইনজীবীদের গ্রেফতার, মিথ্যা মামলায় জড়ানো, হত্যা, বার কাউন্সিলসহ বিভিন্ন জেলা বার অ্যাসোসিয়েশনের দখল এবং আইনজীবীদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হামলার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ক্রমবর্ধমানভাবে ঘটে চলেছে।
জেএমবিএফ এর এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৩৯১ জনের বেশি আইনজীবীর বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যা চেষ্টা, হামলা,ভাংচুর ও বিস্ফোরক আইনে মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছে, যার মধ্যে ১৩১ জনের বেশি আইনজীবী গ্রেফতার হয়েছেন। এদের অনেককেই সুস্পষ্ট প্রমাণ ছাড়াই কেবল রাজনৈতিক মতাদর্শ বা পেশাগত দায়িত্ব পালনের কারণে আটক রাখা হয়েছে। পাশাপাশি অসংখ্য আইনজীবী হয়রানি, হুমকি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বা হচ্ছেন যার কোন পরিসংখ্যান নেই। গত আট মাসে ইউনুস সরকারের আমলে আইনজীবীদের ওপর সংঘটিত সহিংসতা নিছক কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এসব একটি পরিকল্পিত ও সংগঠিত হামলা—দেশের বিচারব্যবস্থা, আইনশাসন ও গণতন্ত্রের ওপরই সরাসরি নির্মম আঘাত।
গ্রেফতার ও অবৈধ আটক: ভিন্নমতের বিরুদ্ধে সরকারের হুঁশিয়ারি
বর্তমান সরকারের অন্যতম কৌশল হলো আইনজীবীদের রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য গ্রেফতার করা এবং দীর্ঘদিন আটক রাখা। বর্তমান সরকার আইনজীবীদের গ্রেফতার ও অবৈধ আটকের মাধ্যমে রাজনৈতিক দমন-পীড়নের এক নতুন মাত্রা চালু করেছে। রাতের আঁধারে, আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে, মানবাধিকার ও সংবিধানসম্মত সুরক্ষা উপেক্ষা করে আইনজীবীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে একটি স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হচ্ছে—ভিন্নমত পোষণ করলে বা সরকারের বিরোধিতা করলে তা সহ্য করা হবে না।
উদাহরণস্বরূপ, গত ৭ এপ্রিল, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকে তার বাসা থেকে আটক করা হয় এবং তাকে একটি রাজনৈতিক মামলায় চার দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। অথচ বিগত সরকারের পতনের পর তিনি নিজেই বর্বর হামলার শিকার হয়েছিলেন। তার ওপর সেই হামলার কোনো তদন্ত না করে, উল্টো তাকে একটি ভিত্তিহীন মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে, যা তার অতীত কর্মকাণ্ডের প্রতিশোধ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
অ্যাডভোকেট আকরাম হোসেন, অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান দিপু, অ্যাডভোকেট মোর্শেদ ও অ্যাডভোকেট সৈয়দ কবির হোসেন জনির মতো বিশিষ্ট আইনজীবীদেরও শুধুমাত্র বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষে মামলা পরিচালনার ‘অপরাধে’ গ্রেফতার করা হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এমন সাহস না দেখায়।
৬ এপ্রিল, ৮৪ জন আওয়ামীপন্থী আইনজীবী আদালতে আত্মসমর্পণ করলে, হাইকোর্ট কর্তৃক প্রদত্ত জামিন বাতিল করে তাদের জেলহাজতে পাঠানো হয়। এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত এবং সরকারের ইচ্ছামতো বিচার ব্যবস্থাকে পরিচালনার নগ্ন উদাহরণ।
গ্রেফতারকৃত আইনজীবীদের অনেককে অমানবিক অবস্থায় রাখা হয়েছে—তাদের হাত হ্যান্ডকাফ দিয়ে পিছনমোরা করে বেঁধে আদালতে হাজির করা হচ্ছে, যা সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের চরম লঙ্ঘন। এই সমস্ত পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আইনজীবী সমাজকে ভীত করা ও নিশ্চুপ করে দেওয়া।
মিথ্যা মামলা: একটি রাজনৈতিক অস্ত্র
সরকারের আরেকটি ভয়াবহ কৌশল হলো—আইনজীবীদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা দায়ের করা। গত ১২ ফেব্রুয়ারি, কুমিল্লায় এক বিক্ষোভে হামলার অভিযোগে ৩২ জন আইনজীবীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়—যা একটি সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ। এতে তাদের জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে অংশগ্রহণ রোধ করার সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য লক্ষ্য করা যায়।
এছাড়াও, ঢাকার ঐতিহ্যবাহী আদালতে ফেব্রুয়ারিতে একটি হামলার ঘটনায় ১৪৪ জন আওয়ামীপন্থী আইনজীবীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। চট্টগ্রামে ৭০ জন এবং ঢাকায় ফেরিওয়ালার মৃত্যুর ঘটনায় ১১ জন আইনজীবীকে জড়িয়ে মামলা করা হয়েছে—যেখানে তাদের বিরুদ্ধে কোনও দৃশ্যমান প্রমাণ নেই।
শারীরিক হামলা ও ভীতি প্রদর্শন
শুধু গ্রেফতার কিংবা মামলা নয়, আইনজীবীদের ওপর শারীরিক হামলাও উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। মার্চ মাসে জামালপুরে তিনজন বিশিষ্ট আইনজীবী পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে হামলার শিকার হন। ঢাকায় অ্যাডভোকেট মোর্শেদ হোসেন শাহীন ও শেখ ফরিদকে আদালত চত্বরে আক্রমণ করা হয়। আগস্টে সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনে ব্যারিস্টার আশরাফুল ইসলামকে ছুরিকাঘাত করা হয়।
এইসব হামলা সরকারবিরোধী কণ্ঠরোধের একটি অংশ। এতে স্পষ্ট করে বলা হচ্ছে—রাজনৈতিক ভিন্নমত পোষণ করলে কিংবা বিরোধী পক্ষকে প্রতিনিধিত্ব করলে, তার শারীরিক নিরাপত্তা থাকবে না।
হত্যা: দমন-পীড়নের চূড়ান্ত রূপ
আইনজীবীদের ওপর দমন-পীড়নের সর্বশেষ ও ভয়ঙ্কর রূপ হলো হত্যাকাণ্ড। মৌলভীবাজারের অ্যাডভোকেট সুজন মিয়াকে এপ্রিলে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। অভিযোগ, তিনি আওয়ামী লীগপন্থী আসামিদের পক্ষে আদালতে লড়ছিলেন। এর আগে ৫ আগস্ট বাগেরহাটে আওয়ামীপন্থী তরুণ আইনজীবী নয়ন শেখ নিজ বাসায় নৃশংসভাবে খুন হন।
এই হত্যাকাণ্ডগুলো নিছক অপরাধ নয়; এগুলো সরকারের স্পষ্ট বার্তা—যারা তাদের বিরোধিতা করবে বা প্রতিরোধ করবে, তাদের জীবন বিপন্ন হবে।
বার নির্বাচন ও গণতন্ত্রের সংকট
ইউনুস সরকারের অধীনে বার নির্বাচনেও সরাসরি হস্তক্ষেপ দেখা যাচ্ছে। ঢাকা, খুলনা ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অফিস বিএনপি-জামায়াতপন্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল করে। চট্টগ্রামে ১০ এপ্রিল আওয়ামীপন্থী আইনজীবীদের মনোনয়নপত্র সংগ্রহে বাধা দেওয়া হয়। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত রাজবাড়ী, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ ও দিনাজপুরে বিরোধীপন্থী আইনজীবীদের প্রার্থীতা বাতিল বা নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধা দেওয়া হয়েছে।
নব্য স্বৈরাচারের ছায়ায় বাংলাদেশ
বাংলাদেশে আইনজীবীদের পেশাগত স্বাধীনতা আজ চরমভাবে বিপন্ন। ইউনুস প্রশাসন একটি সংগঠিত কৌশলের মাধ্যমে আইন পেশাকে দুর্বল করছে, যাতে তারা যেকোনো বিরোধী কণ্ঠস্বরকে সহজেই দমন করতে পারে। আইনজীবীরা যদি চুপ করে যান, তাহলে সরকার কোনো জবাবদিহিতা ছাড়াই একচ্ছত্র ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান
এই অবস্থা চলতে থাকলে শুধু বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নয়, বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যতও ধ্বংস হয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা—নিষেধাজ্ঞা, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও কূটনৈতিক চাপের মাধ্যমে একটি স্পষ্ট বার্তা দেওয়া যে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচার বিভাগের উপর হামলা সহ্যযোগ্য নয়।
উপসংহার: প্রতিরোধের ডাক
আইনজীবীদের বিরুদ্ধে এই দমন-পীড়ন গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে হামলা। এটি ইউনুস সরকারের কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। গ্রেফতার, মিথ্যা মামলা, শারীরিক সহিংসতা ও হত্যা—এইসবের মাধ্যমে আইন পেশাকে দুর্বল করা হচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকে একটি দমনমূলক রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে।
বাংলাদেশের জনগণ, সুশীল সমাজ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এখনই সম্মিলিতভাবে এই হামলার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। নতুবা বাংলাদেশের গণতন্ত্র শুধু বিপন্নই নয়, সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
লেখক: একজন বাংলাদেশি মানবাধিকার আইনজীবী এবং ২০২৩ সালে ফ্রান্স সরকারের ম্যারিয়ান ইনিশিয়েটিভ ফর হিউম্যান রাইটস ডিফেণ্ডার্স পুরস্কার প্রাপ্ত। বর্তমানে জাস্টিসমেকার্স বাংলাদেশ ইন ফ্রান্স (জেএমবিএফ) এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইমেইল: shahanur.islam@jmbf.org,ওয়েবসাইট: www.jmbf.org, মোবাইল/হোয়াটসঅ্যাপ: +৩৩৭৮৩৯৫২৩১৫
JMBF is an independent non-profit, nonpartisan human rights organization registered in France with registration number W931027714 under the association law of 1901, dedicated to defending human rights, fighting for justice, and empowering communities in Bangladesh and beyond.
No comments:
Post a Comment