Saturday, August 2, 2014

গৃহশ্রমিকের অধিকারঃ আইন ও বাস্তবতা

অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকতঃগৃহশ্রমিক, যার দিন শুরু হয় ভোরের পাখি ডাকার সাথে সাথে আর দিন শেষ হয় পৃথিবীর সব কোলাহল স্তব্ধ হলে। বাড়ীর সবার আগে ঘুম থেকে ওঠে যাদের ঘুমাতে যেতে হয় সবার পরে। সবার জন্য খাবার ব্যবস্থা করা সত্বেও যাদের সবার খাওয়া শেষে অবশিষ্ট খেয়ে ক্ষুধা
নিবারণ করতে হয়।দারিদ্রের চরম শিকার এই গৃহশ্রমিকের সবচেয়ে সহজলভ্য গৃহশ্রমকে তাদের জীবীকার জন্য বেঁছে নিতে হয়। যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত নারী ও শিশু।

গৃহকর্মে নিয়োজিত হাজার হাজার শ্রমিকের জীবনে বঞ্চনার পাশাপাশি প্রতিনিয়ত  গৃহকর্তা ও তার পরিবারের সদস্য কর্তৃক অবর্ণনীয় অত্যাচার, দুর্ব্যবহার, যৌন নিপিড়ন ও নির্যাতন, হত্যা, নির্মম প্রহার, বকা-ঝকা, মারপিট, নখ তুলে ফেলা, বৈদ্যুতিক শক, গরম খুন্তি বা ইস্ত্রি বা গরম পানি ঢেলে দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ পুড়িয়ে দেওয়াসহ বিভিন্নপ্রকার নির্যাতন ও অবমাননা সহ্য করতে হয়। যার অধিকাংশ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয় না বলে জনসম্মুখের আড়ালেই থেকে যায়।

ফলে  তাদের সে সকল মানবাধকার লংঘনের প্রতিকার করার কেউ নেই, সবই যেন তাদের নিয়তি। আইন, আদালত, সমাজ, রাষ্ট্র সব দেখে,শোনে কিন্তু নিশ্চুপ। বর্তমান সভ্য সমাজের আর্থ-সামাজিক বিবেচনায় গৃহশ্রমিকদের জন্য আইন,নীতিমালা,আচরণবিধি প্রণয়নের চাহিদার ফলশ্রুতিতে সারা বিশ্বের অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমখাতের এই বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের কাজকে শোভনীয় করার লক্ষ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়েছে।

তারই ধারাবাহিকতায়,গত ১৬ জুন ২০১১ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)এর সাধারণ সম্মেলনের শততম অধিবেশনে গৃহশ্রমিকের শোভন কাজ সংক্রান্ত কনভেনশন [কনভেনশন ১৮৯, গৃহশ্রমিক কনভেনশন ২০১১] গৃহীত হয়েছে।

আইএলও কভেনশন ১৮৯ এর অনুচ্ছেদ ৩ এ বলা হয়েছে:

১। প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্র উক্ত কনভেনশনে বর্ণিত সকল গৃহশ্রমিকের মানবাধিকারের কার্যকর সুরক্ষা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

২। প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্র গৃহশ্রমিক সম্পর্কিত নিম্নলিখিত বিষয়সমূহসহ উক্ত কনভেনশনে বর্ণিত কর্মেক্ষেত্রের মৌলিক নীতি ও অধিকারসমূহকে মেনে চলা, উন্নীত করা ও স্বীকৃতি দানের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবে

-সংগঠনের স্বাধীনতা এবং যৌথ দর কষাকষির অধিকারের কার্যকর স্বীকৃতি;

সকল প্রকার জবরদস্তিমূলক ও বাধ্যতামূলক শ্রম নির্মূল করা;

-শিশুশ্রমকে কার্যকরভাবে নিরসন করা;

চাকরি ও পেশার সাথে সম্পর্কিত সকল প্রকার বৈষম্য দূর করা।

৩। গৃহশ্রমিক ও গৃহশ্রমিক নিয়োগকারীদের সংগঠনের স্বাধীনতা এবং যৌথ দর কষাকষির অধিকারের কার্যকর স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে, সদস্য রাষ্ট্রসমূহ গৃহশ্রমিক ও গৃহশ্রমিক নিয়োগকারী সংগঠন প্রতিষ্ঠা, এবং সংগঠনের বিধান অনুয়ায়ী সংগঠন, ফেডারেশন এবং কনভেনশনে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী যোগদান করার অধিকার সুরক্ষিত করবে।

কভেনশনের অনুচ্ছেদ ৪ এ বলা হয়েছেঃ

১। প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্র ন্যূনতম বয়স সংক্রান্ত কনভেনশন, ১৯৭৩ (নং ১৩৮), এবং অত্যন্ত খারাপ ধরনের শিশু শ্রম সংক্রান্ত কনভেনশন, ১৯৯৯ (নং ১৮২) এর সাথে সঙ্গতি রেখে গৃহশ্রমিকের জন্য একটি ন্যূনতম বয়সসীমা নির্ধারণ করবে; এবং এই ন্যূনতম বয়স সাধারণভাবে শ্রমিক সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় আইন ও বিধিবিধানে বর্ণিত বয়সের চেয়ে কম হবে না।

২। প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা বিশ্চিত করবে যেন অনুর্ধ্ব ১৮ বছরের গৃহশ্রমিক এবং ন্যূনতম বয়সের চেয়ে বেশি বয়সি গৃহশ্রমিকদের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, অথবা উচ্চশিক্ষা বা বৃত্তিমূলক (ভকেশনাল) প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়।

অনুচ্ছেদ ৫ এ রয়েছে:

প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্র গৃহশ্রমিকদের সকল প্রকার নিপীড়ন, হয়রানি ও সহিংসতা থেকে সুরক্ষিত রাখতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করবে।

অনুচ্ছেদ ৬ এ উল্লেখ করা হয়েছে:

প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্র অন্যান্য সাধারণ শ্রমিকের ন্যায় গৃহশ্রমিকেরাও যেন চাকরির ন্যায়সঙ্গত শর্তাদি ও শোভন কার্মপরিবেশ ভোগ করতে পারে, এবং যদি তাদেরকে নিয়োগকারীর গৃহে বসবাস করেত হয়, তবে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করে শোভন পরিবেশে থাকতে পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে।

ইতোমধ্যেই আইএলও কনভেনশন ১৮৯ এর আলোকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গৃহশ্রমিকদের অধিকার আইন প্রণীত হয়েছে এবং হচ্ছে। আমাদের পার্শবর্তী দেশ ভারত কেন্দ্রীয়ভাবে গৃহশ্রমিক অধিকার (সুরক্ষা) আইন ২০০৮ প্রণয়ন করেছে। সিঙ্গাপুরে আইন ছাড়াও সম্প্রতি গৃহশ্রমিকদের জন্য সপ্তাহে এক দিন ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

প্রেক্ষিত বাংলাদেশ:

বাংলাদেশে গৃহশ্রমিকের অধিকার ও সুরার বিষয়টি অনেকবার আলোচনায় উঠে আসলেও তা বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক মানবাধিকার এমনকি শ্রমিক আন্দোলনেও যথাযথভাবে প্রাধান্য পায়নি। তাই বিষয়টি নীতিনির্ধারণী মহলে কার্যকর মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়নি, ফলে তারা অধিকার বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে।

যদিও আমাদের সংবিধানের ১৪, ১৫, ১৭, ২৮, ৩৪ ও ৩৬ নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে গৃহশ্রমিকের অধিকার সুরক্ষিত আছে। কিন্তু শুধু গৃহশ্রমিকের জন্য নির্দিষ্ট কোন আইন বা নীতিমালা নেই।

শ্রমিকের অধিকার বিষয়ক শ্রম আইন, যা ২০০৬ সালে প্রনীত হযেছে, সেখানেও গৃহশ্রমিকদের অধিকারের বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে। এমন কি গৃহশ্রমিককে শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতিও দেওয়া হয়নি। ফলে তারা কর্মক্ষেত্রে নানা রকম অনিয়ম, নিপীড়ন, নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার হলেও তার কোন সঠিক প্রতিকার পায় না।

১৯৬১ সালে গৃহশ্রমিকের রেজিষ্ট্রেশন সংক্রান্ত একটি অর্ডিন্যান্স প্রনীত হয়েছিল। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে এবং সরকারের উদ্যোগের অভাবে তার সুফল থেকে গৃহশ্রমিকেরা বঞ্চিত হয়েছে। তাছাড়া, সরকার ২০১০ সালে গৃহশ্রমিক সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালার খসড়া প্রনয়ন করলেও এখন তা চুড়ান্ত করেনি। তাই যত দ্রুত সম্ভব গৃহকর্মে নিয়োজিত কর্মীদের জন্য প্রণীত খসড়া নীতিমালার অনুমোদন এবং তা বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

গৃহশ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করতে আইএলও কনভেনশন ১৮৯ একটি আন্তর্জাতিক দলিল। এ কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের এটা অনুমোদন ও অনুসরণ এবং নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন করার বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। শুধু অনুমোদন আর আইন প্রনয়ন নয়, এই কনভেনশনে গৃহশ্রমিকের যে সকল অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে তা নিশ্চিত করতে সরকারের অতি সত্ত্বর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

লেখক:মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও সাংবাদিক; প্রতিষ্ঠাতামহাসচিব, জাস্টিসমেকার্সবাংলাদেশ; মোবাইলঃ ০১৭২০৩০৮০৮০, ইমেল: saikotbihr@gmail.com, ব্লগ: www.shahanur.blogspot.com


নিবন্ধটি নিম্নোক্ত নিউজ মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে:













১৩। আইএলও কনভেনশন স্বীকৃত গৃহশ্রমিকের অধিকারঃ আইন ও বাস্তবতা, EkusheyNews24.Com, March 01, 2013

১৪। গৃহশ্রমিকের অধিকার: আইন ও বাস্তবতা, 52Somachar.Com, February 27, 2013

15. গৃহশ্রমিকের অধিকার: আইন ও বাস্তবতা, The Daily Jai Jai Din, October 1, 2013

======================================================================  
Personal site of Advocate Shahanur Islam (an young, ascendant and promising human rights defender and lawyer) working for ensuring human rights, rule of law and social justice in Bangladesh and the Globe. কপিরাইট © অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত. সকল সত্ব ® সংরক্ষিত. শাহানূর ডট ব্লগস্পট ডট কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোন নিবন্ধ, মতামত, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, ভিডিও চিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ব্যতীত ব্যবহার আইনগত দণ্ডনীয়.